মৌলভীবাজারের বড়লেখার চাঞ্চল্যকর আইনজীবী আবিদা সুলতানা হত্যার রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। রিমান্ডে থাকা ইমাম তানভীর হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছেন। ওই আইনজীবীর পৈতৃক বাড়িতে ভাড়া থাকতেন ইমাম তানভীর আলম ও তাঁর পরিবার। তাঁর কর্মকাণ্ডে অতিষ্ট হয়ে দীর্ঘদিন ধরে বাড়ি ছাড়তে বলছিলেন আবিদা। কিন্তু তানভীর কিছুতেই বাড়ি ছাড়ছিলেন না। এ নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। ঘটনার দিন তানভীরের সঙ্গে আবিদার বাকবিতণ্ডা হয়। পরে তানভীর ক্ষুব্ধ হয়ে আবিদাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করেন। একপর্যায়ে পানির ফিল্টারের পাথরের ঢাকনা দিয়ে আঘাত করে আবিদার মৃত্যু নিশ্চিত করেন।
শনিবার বিকেলে মৌলভীবাজার মডেল থানায় সংবাদ সম্মেলন করে বিষয়টি জানান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রাশেদুল ইসলাম। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন মৌলভীবাজার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আলমগীর হোসেনসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা। রাশেদুল ইসলাম বলেন, তানভীর আলম গতকাল শুক্রবার বড়লেখা জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে আইনজীবী আবিদা সুলতানাকে হত্যা করার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। এই হত্যার সঙ্গে শুধু তানভীরই জড়িত। ঘটনার দিন ২৬ মে তানভীর বাড়িতে একা ছিলেন। তাঁর মা ও স্ত্রী বাইরে ছিলেন। আর ধর্ষণেরও কোনো আলামত পাওয়া যায়নি।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে আবিদা তানভীরকে বলেছিলেন, তাঁর লুঙ্গি খুলে ফেলবেন। এই কথার ক্ষোভ থেকেই তানভীর আবিদাকে আঘাত করার পর শরীর থেকে কাপড় খুলে ফেলেন। তবে ধর্ষণের কোনো আলামত তদন্ত ও মেডিকেল পরীক্ষা কিংবা তানভীরও স্বীকারোক্তি দেননি। এ ঘটনার সঙ্গে তাঁর পরিবারের আর কেউ জড়িত নন। ২৬ মে বেলা ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে আবিদাকে হত্যা করা হয়।
বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণভাগ উত্তর ইউপির মাধবগুল গ্রামের প্রয়াত আব্দুল কাইয়ুমের তিন মেয়ে। স্ত্রী দ্বিতীয় মেয়ের বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজারে থাকেন। মেয়েদের মধ্যে আবিদা সুলতানা (৩৫) সবার বড়। তিনি মৌলভীবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী। আবিদার স্বামী মো. শরিফুল ইসলাম বসুনিয়া একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করেন। তিনি স্বামীর সঙ্গে মৌলভীবাজার শহরে বসবাস করতেন। ছুটির দিনে প্রায়ই পৈতৃক বাড়ি দেখাশোনা করতে যেতেন আবিদা। পৈতৃক বাড়িতে চার কক্ষবিশিষ্ট ঘরের দুই কক্ষে আবিদা সুলতানা ও তাঁর বোনেরা বেড়াতে গেলে থাকেন। বাকি দুটোতে ভাড়া থাকতেন তানভীরের পরিবার। তিনি তাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় ও স্থানীয় মসজিদের ইমাম।
২৬ মে সকালে আবিদা সুলতানা বিয়ানীবাজার থেকে ওই বাসায় পৌঁছান। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ফোন দিয়ে তাঁর স্বামীর সঙ্গে কথা বলেন। ইফতারের আগে মৌলভীবাজার শহরে পৌঁছাবেন বলেও জানান। এরপর বিকেল ৫টার দিকে স্বামীর মুঠোফোন থেকে ফোন দিলে বন্ধ পাওয়া যায়। এরপর আবিদা সুলতানার স্বামী ও বোনরা তাঁকে খুঁজতে বাবার বাড়ি মাধবগুল গ্রামে আসেন। বাড়িতে এসে তাঁরা ঘরের কক্ষ বন্ধ দেখতে পান। এ সময় বাসার ভাড়াটিয়া তানভীর আলমের পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি। ঘটনাস্থলের পাশেই তাদের এক আত্মীয় বাড়িতে তানভীরের মা ও স্ত্রী ছিলেন। পরে তাঁদের কাছ থেকে চাবি এনে ওই দিন রাত ১০টার দিকে পুলিশ ঘরের দরজা খুলে দেখে আবিদা সুলতানার মৃতদেহ রক্তাক্ত অবস্থায় ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে। পুলিশ ওই দিন রাতেই তানভীর আলমের স্ত্রী ও মাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে। পরদিন ২৭ মে দুপুরে শ্রীমঙ্গলের বরুণা এলাকা থেকে ইমাম তানভীর আলমকে আটক করা হয়। ওই দিনই বড়লেখা থানায় চারজনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন আবিদা সুলতানার স্বামী মো. শরিফুল ইসলাম বসুনিয়া। এরপর তানভীর আলমের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাঁর ব্যাগ থেকে আবিদা সুলতানার ব্যবহৃত দুটি মুঠোফোন শ্রীমঙ্গল থেকে উদ্ধার করে শ্রীমঙ্গল থানা পুলিশ।
আবিদা সুলতানা হত্যা মামলার আসামিরা হচ্ছেন আবিদা সুলতানার বাবার বাসার ভাড়াটিয়া তানভীর আলম (৩৪), তানভীরের ছোট ভাই আফছার আলম (২২), স্ত্রী হালিমা সাদিয়া (২৮) এবং মা নেহার বেগম (৫৫)। তাদের স্থায়ী ঠিকানা সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার ছিল্লারকান্দি। মামলার পরই তাঁদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে গত ২৮ মে দুপুরে বড়লেখার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম হরিদাস কুমারের আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করে পুলিশ। শুনানি শেষে আদালত তানভীর আলমের ১০ দিন এবং তাঁর স্ত্রী সাদিয়া ও মা নেহার বেগমের আট দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ঘটনার পর থেকে তানভীরের ছোট ভাই আফছার আলম পলাতক রয়েছেন।